অনুসরন করুন :
আল-কুরআন

আল— হজ্ব : ৩০ থেকে ৩৯

আল কুরআন (আল— হজ্ব : ৩০ থেকে ৩৯) ৩০. এগুলো (হজ্বের বিধান)। এ ছাড়া যে, আল্লাহ এবং পবিত্র (স্থান ও অনুষ্ঠান) সমূহের প্রতি সম্মান দেখাবে, তার প্রভ...

বিস্তারিত
আল-হাদীস

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন

সাঈদ ইবনু আবদুর রহমান মাখযূমী রা. আব্বাদ ইবনু তামীম তৎপিতৃব্য আবদুল্লাহ্ ইবনু যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয...

বিস্তারিত
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো

নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। নিঃসন্দেহে এই সরকার একটি বিপ্লবোত্তর সরক...

বিস্তারিত

আল কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষ

ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান আলমারূফ 

আল কুরআন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময়। বিশ্ব মানবতার জন্য হিদায়াতের আলোয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ এক অবিনাশি, অবিনশ্বর, শাশ্বত, চিরন্তন জীবনাদর্শের প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ আল কুরআন। আল কুরআন মানুষ ও স্রষ্টার মাঝে অন্যতম সেতুবন্ধন। এ কুরআন এমন একটি জ্ঞানের উৎস যা মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত মানব জাতিকে সর্বোত্তম ও সঠিক পথের দিশা দিবে। 

প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে মরুদুলাল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর সুদীর্ঘ ২২ বছর ৫ মাস ১৪ দিনে প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে অল্প অল্প করে আল কুরআন অবতীর্ণ হয় যা আজও যুগ জিজ্ঞাসার সূ²তিসূ² প্রশ্নের জবাবে, সমকালীন চাহিদা পূরণে, জ্ঞানের আধুনিকতায়, সভ্যতা ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং মননশীলতা নিরিখে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা নিয়ে সামগ্রিক কল্যাণের পাথেয় হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত। আরবি ভাষায় নাযিলকৃত আল কুরআনের ভাষা সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও হৃদয়স্পর্শী। কুরআন যেহেতু মানব রচিত সাহিত্য কর্মের ন্যায় কোন সাধারণ সাহিত্য কর্ম নয়,তাই এর ভাষা অভিব্যক্তি, ছন্দের ব্যঞ্জনা, বিষয় বস্তুর অভিনব গ্রন্থনা, সুরের মূর্ছনা, শব্দঝংকার, বাক্যের অনুপম শৈল্পিক বিন্যাস, রচনাশৈলীর উৎকর্ষ, অপূর্ব প্রকাশরীতি, উপমার বৈচিত্র্য, দ্যুতি, উচ্চমানের আলংকারিক গ্রন্থনা, অতুলনীয় উপমা উৎপ্রেক্ষা এক অত্যুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। 

যা পাঠ করলে বার বার পাঠের স্পৃহা জাগে, যা শুনলে অন্তকরণ প্রকম্পিত হয়, হৃদয় ছুঁয়ে যায়, ছন্দের ঝংকারে দোলা লাগে প্রাণে। এর বর্ণ, শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ, রচনাশৈলী, উপমা, বৈচিত্র্য, ঘটনার বর্ণনা, কসম ও আনুসঙ্গিক সকল দিক ও বিভাগ মানবাতীত কর্মকুশলার প্রতিচ্ছবি। অনুসন্ধিৎসু সাধারণ পাঠক কুরআন পাঠ করা মাত্রই বুঝতে পারেন ইহা মানবরচিত কোন গ্রন্থ নয়।। কেননা আল কুরআনের অনুপম শৈল্পিক বিন্যাস, রচনাশৈলী, শব্দচয়ন, উপস্থাপনা ও বিবেচ্য বক্তব্য সর্বতোভাবে আল কুরআনের অলৌকিকতাকেই নির্দেশ করে, ইঙ্গিতবহ আর প্রজ্ঞাময় শব্দ ব্যবহার একে মহিমান্বিত করেছে। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআনের বিন্যাস ও রচনাশৈলীর ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য বিশ্লেষনের চেষ্টা করা হয়েছে। 

শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষ ঃ সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ আল কুরআন মহান আল­াহর পক্ষ থেকে এমন একজন ব্যক্তির ওপর নাযিল হয়েছে যার কোন অক্ষরজ্ঞান ছিল না। আল­াহ তায়ালা ইচ্ছা করেই এমনটি এই জন্য করেছেন যাতে প্রমাণিত হয় যে, এ গ্রন্থটি এমন চমকপ্রদ আলঙ্কারিক ভাষা ও শৈলী বহন করে যা কোন নিরক্ষর লোকের  ব্যক্তিগত ভাষা হতে পারে না। যে সময় কুরআন নাযিল হয়, সে সময় আরবে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের অভাব ছিল না। কিন্তু তারপরও আল­াহ যখন কুরআনের অনুরূপ কুরআন সৃষ্টির জন্য চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করলেন; তখন এসব কবি-সাহিত্যিক অপরাগতা প্রকাশ করে বলল: লাইসা হাযা মিন কালামিল বাশার’ (এটা কোন মানব রচিত বাণী নয়) এর রচনাশৈলী ও বিন্যাস পদ্ধতি উঁচু মানের। এ গ্রন্থে উঁচু স্তরের শিল্পকলা বিদ্যমান, যা কুরআনের বিশেষ কোন অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা কুরআনে তা সমভাবে বি¯তৃত। সমস্ত উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যের বর্ণনাধারা পর্যন্ত এক ও অভিন্ন। কুরআনের উন্নত শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষ তথা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কুরআন অবতীর্ণের সমসাময়িক সময়ে আরবের কাফির মুশরিকগণ কখনও কুরআনকে কাব্য আবার কখনো যাদু বলে আখ্যায়িত করতো। শৈল্পিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েও কাফির মুশরিকগণ বলতে পারেনি সৌন্দর্যমণ্ডিত সে বস্তুটি কী? কুরআন অবর্তীণের প্রাক্কালে কুরআন কাফির ও মুমিন উভয় গোষ্ঠীর ওপরই যাদুর মত কাজ করেছে। যাদুর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কেউ সত্যাশ্রয়ী মুসলমান হয়েছে। আবার কেউ এর মায়াজালে আবদ্ধ হয়েও এর থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কেউই সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেনি কুরআনের কোন অংশটি তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। 

হযরত ওমর (রাঃ) নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, ‘যখন আমি কুরআন শ্রবণ করলাম তখন আমার মধ্যে এক ভাবান্তর সৃষ্টি হলো, যার কারণে আমি কাঁদতে লাগলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম।ওয়ালিদ বিন মুগীরা বলেছেন: কুরআনের মধ্যে যাদুকরী প্রভাব বিদ্যমান, তোমরা কি লক্ষ্য করনি কিভাবে কুরআন একজন মানুষকে তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে পৃথক করে দেয়?’ মুমিনগণ কুরআন পাঠ করার পর যে প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কুরআনেই বলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে: কুরআন পাঠে তাদের লোম কাটা দিয়ে ওঠে চামড়ার ওপর, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের শরীর ও মন আল­াহর যিকিরে একাকার হয়ে যায়

কুরআন সম্পর্কে তাদের এ ধরনের মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে আজও একটি প্রশ্ন জাগে যে, কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য কেন এতো মনোহর? এটা কি আল কুরআনের অনুপম বিন্যাসশৈলীর কারণে না অন্য কিছু? গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনের প্রতি এই আকর্ষণ কেবল মহান আল­াহ তায়ালার শৈল্পিকবিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষের কারণেই। সাহাবিগনের যুগে কুরআনের তাফসিরের ক্ষেত্রে  তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না। কেননা সাহাবিগণ কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না।  সাহাবায়ে কিরাম বিভিন্ন বর্ণনা সূত্রের মাধ্যমে কুরআনের অনেক আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, যা কুরআনের বিষয় ও ভাষ্য সংক্রান্ত সরাসরি রাসূল (সাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। সাহাবিগনের কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন আবার কেউ কুরআনের ব্যাখ্যা করাকে গুনাহের কাজ মনে করেছেন। হিশাম বিন ওরওয়া বিন যুবাইর (রাঃ) বলেন: আমি আমার পিতাকে কখনো কুরআনের ব্যাখ্যা করতে শুনিনি 

সাহাবিগণের যুগের পর তাবেয়ীদের যুগে কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ তাফসির শাস্ত্রের কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। এ সমযে কুরআনের কোন আয়াতের তাফসির অনুরূপ কোন বাক্য বা শব্দ দিয়েই করা হতো। তবে তাফসির শাস্ত্রে বি¯তৃতি ঘটে হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে। কিন্তু তখন কুরআনের শিল্প সৌন্দর্য ও তার তাৎপর্য বর্ণনার পরিবর্তে সেখানে ইতিহাস, ব্যাকরণ,দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের বিষয়বস্তু প্রাধান্য লাভ করে। এভাবে তারা কুরআনের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়ে। অবশ্য মুতাআখখেরীনগণের মধ্যে আল­ামা যামাখশারী কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু তিনিও এ কাজে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কেননা তাঁর বর্ণনা ও উপস্থাপনার মধ্যে গভীরতা কমই পরিলক্ষিত হয়। আল কুরআনের সর্বত্র শৈল্পিক অলৌকিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। শৈল্পিক চিত্রসমূহকে একত্রিত করে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করলে কুরআনের সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষের বৈশিষ্ট্য যে কুরআনের সর্বত্র নিপুণ শিল্পকলার মতো ছড়িয়ে আছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। নিবন্ধে শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষের বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করা হলোঃ

কুরআনের ভাষাশৈলীর কয়েকটি দিক ভাষার অন্তমিল ও ছন্দবিন্যাস ঃ আল কুরআনের ছন্দ বিন্যাসকে সাজাবলে। অর্থাৎ এর কোন নির্দিষ্ট অন্তমিল না থাকলেও এর মধ্যে কাব্যিকভাব পুরোপুরি বিদ্যমান। এ কারণে কুরআনকে গদ্য কিংবা পদ্যের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কোন কোন সুরা অথবা সুরার অংশবিশেষে আমরা সুনির্দিষ্ট অন্তমিল খুঁজে পাই। যেমন আল­াহর বাণী (ইন্না আতয়না কালকাওছার। ফাসালি­লি রাব্বিকা ওয়ানহার। ইন্না শানি আকা হুয়াল আবতার ঃ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওছারদান করেছি। অতঃপর আপনার প্রভুর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন। যে আপনার শত্র“, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।) আয়াত তিনটির প্রতিটি রাঅক্ষর দিয়ে শেষ হয়েছে। এভাবে কুরআনের অনেক সূরা আছে যাতে অন্তমিল লক্ষ্য করা যায়। মানব রচিত সাহিত্য কর্ম  যদি ছন্দময় হয় তবে তা মানুষের মনে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ অনুভূতি সৃষ্টি করে। কিন্তু কুরআন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেননা কুরআনের আয়াত গদ্যই হোক বা পদ্যই হোক এর একটি চিরস্থায়ী প্রভাব পাঠক বা এর শ্রবণকারীর ওপর পড়ে। এই প্রভাব নিঃসন্দেহে কুরআনে বিন্যাসশৈলীর কারণে।

 কুরআনের সাহিত্যশৈলী ঃ কুরআনের সাহিত্যশৈলী মানবরচিত সাহিত্যশৈলীর আওতায় পড়ে না। মানব রচিত সাহিত্য শৈলীতে যেমন-গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও  পৌরাণিক কাহিনী লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু কুরআন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মি. বেল-এর মতে: কুরআনে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে একজন কবি হিসেবে স্বীকৃত দেয় না, বরং তাঁর কাজ ছিল আল­াহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ জন্যেই কুরআনের ভাষা যতটা না শিল্প-সৌন্দর্যমণ্ডিত, তার চেয়ে বেশি উপদেশমূলক।যুগে যুগে আরব সাহিত্যিক  ও ভাষাবিদগণ কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাস ও শৈলী সম্পর্কে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মতে, কুরআনের ভাষা ও সাহিত্যশৈলীর কোন তুলনা নেই। এটি শাশ্বত ও চিরন্তন মুজিযা, যার চ্যালেঞ্জ সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য।

আয়াতের পুনরাবৃত্তি ঃ সাধারণ সাহিত্যকর্মে একই কথার পুনরাবৃত্তি যেখানে বিরক্তির উদ্রেক করে, সেখানে কুরআনের আয়াতের পুনরাবৃত্তি পাঠক ও শ্রোতার মনে স্বর্গীয় সুখানুভূতি জাগ্রত করে। আর এটা কুরআনের অনুপম সাহিত্যশৈলীর কারণেই সম্ভব হয়েছে। যেমন আল­াহর বাণীঃ ফাবি আয়্যি আলা-ই রাব্বিকুমা তুকাযযিবানএ আয়াতটি সূরা আর-রাহমানে ৩১ বার উলে­খ করা হয়েছে। কুরআনের কোন পাঠক বা এর শ্রবণকারী এ আয়াত পাঠ করে কিংবা শ্রবণ করে বিরক্ত হয়েছে এমন নজির নেই। বরং বিরক্তির পরিবর্তে সুখানুভূতি লাভ করেছে। 

কুরআনের শব্দচয়ন ঃ কুরআনের ভাষায় শৈল্পিক বিন্যাসের আরেকটি দিক হলো শব্দচয়ন পদ্ধতি। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এমন কিছু উপযোগী শব্দচয়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বিন্যস্ত যাতে বাক্য বা আয়াতের বক্তব্য পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। যথা আল­াহর বাণী ঃ কাল­া লাইন লাম ইয়ানতাহি লানাসফায়াম বিন নাসিয়াহ, নাসিয়াতিন কাযিবাতিন খাতিয়াহ’ (কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনেই কেশগুলো ধরে হেঁচড়াবই। মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ।) উলে­খিত আয়াতে কিছু শব্দকে সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন লানাসফায়ানশব্দের স্থলে যদি এর সমার্থবোধক শব্দ লানাখুযান্নাব্যবহার করা হতো তবে অর্থের দিক দিয়ে তা এতো বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত হত না, যা লানাসফায়ানশব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে। পরবর্তী আয়াতের নাসিয়াতুন কাযিবাতুন খাতিয়াহএ শব্দটির তাৎপর্য হচ্ছে-কোন অহংকারী বিদ্রোহীকে উচুঁ স্থান থেকে তার কপালের চুল ধরে হেঁচকা টানে ভূলুণ্ঠিত করে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া। টেনে-হেঁচড়ে নেয়ার সময় অবশ্য সে নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিকট চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকে। একথা শুনে শ্রোতাগণ ধারণা করে যে, সম্ভবত জাহান্নামের পাইক পেয়াদাগণ এবং ঐ ব্যক্তির সাথীদের মধ্যে সেদিন সংঘর্ষ বেঁধে যাবে। এ যুদ্ধের ময়দানের এক ভয়ঙ্কর চিত্র মানসপেটে ভেসে ওঠে। এ জন্যে আল­াহ তাদের এ হঠকারিতায় কান না দিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে তার কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবে কাল­া লাতুতিই ওয়াসজুদ ওরাকতারিব’ (কখনো তুমি তার কথায় প্রভাবিত হয়ো না, তুমি সিজদা করো ও আমার নৈকট্য অর্জন করো।) 

উপরিউক্ত আয়াতগুলো বাহ্যিকভাবে অবিন্যস্ত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো বিন্যাসিত ও পরস্পর সংশ্লিষ্ট। শব্দগুলো শৈল্পিকভাবেই বিন্যস্ত। আল­াহর বাণী : মাথায় বার্ধক্যের ছাপ লেগেছে।

আয়াতে উলি­খিত ওয়াসতাআলার রাসু শাইবাকে এভাবে না বলে যদি আল­াহ ওয়াসতাআলাশ শাইবু ফির রাসবলতেন তাহলে তা শৈল্পিক মানসম্মত হবে না। কেননা এ আয়াতের বিন্যাস পদ্ধতিটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও শক্তিশালী। আল­াহর বাণী  আলাম তারা আনাল­াহা আনযালা মিনাস সামায়ি মায়ান ফাসালাকাহু ইয়ানবিআ ফীলআরদি ছুম্মা নুখরিজুবিহী যারআন মুখতালিফাহ আলওয়ানুহু  হুত্বামান, ইন্নাফী যালিকা লাযিকরা লি উলিল আলবাব : তুমি কি দেখ না, আল­াহ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা শুকিয়ে যায় এবং তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তিনি তা খড়-কুটায় পরিণত করেন। অবশ্যই তাতে বোধশক্তিসম্পন্নগণের জন্য উপদেশ রয়েছে।এ আয়াতে ছুম্মাশব্দটি যেভাবে যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে চোখ ও মনকে চিন্তাÑভাবনার পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় অবস্থা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হওয়ার পূর্বেই। কোন দৃশ্য মানুষকে চোখের সামনে তুলে ধরতে যে ধরনের বিন্যাস ও উপস্থাপনার প্রয়োজন, তা এ আয়াতে আছে।

 

কুরআনের উপসংহার পদ্ধতিঃ কুরআনের শৈলীর আরেকটি দিক উপসংহার পদ্ধতি। কুরআনের যেসব আয়াতে আল­াহ তায়ালার সত্তা ও সিফাতের বর্ণনা এসেছে তা সমাপ্ত করা হয়েছে ইন্নাল­াহা আলা কুলি­ শাইয়িন কাদির’ (নিশ্চয়ই আল­াহ সর্ব শক্তিমান)- বাক্য দ্বারা। আবার যেখানে কোন রহস্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তার উপসংহার টানা হয়েছে ওয়াল­াহু আলিমুম বিযাতিছ ছুদুর’ (নিশ্চয়ই আল­াহ অন্তর্যামী) বাক্য দ্বারা। সাধারণ সাহিত্যকর্মে এর কল্পনাও করা যায় না। 

রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আল­াহর সম্ভাষণে আরেক ধরনের ভাষাশৈলী পাওয়া যায়। যেমন : ইয়া আইয়ুহাল মুযযাম্মিল’ ( হে চাদরাবৃত রাসূল!) এ আয়াত দুটিতে আল­াহ তার প্রিয় রাসূলকে যথাক্রমে ওহে চাদরাবৃত ও ওহে বস্ত্রাবৃত হিসেবে সম্ভাবণ করেছেন। সাধারণ কবি-সাহিত্যিকগন নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপরই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন। খুব কম কবি-সাহিত্যিকগন আছেন যারা এই সীমা অতিক্রম করতে পাারেন। যদি কেউ চেষ্টাও করে থাকেন, তবে তা তার নিজস্ব বিষয়ের তুলনায় ততটা মানসম্পন্ন হয় না। অন্যদিকে কুরআনের সাহিত্যিক মান ও সীমাবদ্ধতার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। বিভিন্নমুখী এমনকি পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয়ের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ আল কুরআন, যেখানে প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনাশৈলী সাহিত্যের মান বিচারে সমমানের। 

আল কুরআনের ভাষা, সাহিত্যশৈলী, অলংকার ও বিন্যাসপদ্ধতি সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মনীষীগণের অভিমত থেকেও শৈলী বোঝার ইতিবাচক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ড. তাহা হুসাইন বলেন: এতে কোন সন্দেহ নেই, কুরআন আরবি গদ্যের আদি গ্রন্থ। কিন্তু তোমরা এ হয়তো জান যে, কুরআন গদ্য নয়, তদ্রুপ কুরআন পদ্যও নয়। কুরআন কুরআনই। একে অন্য কোন নাম দেয়া যায় না। কুরআন যে কাব্য নয় তা সহজে প্রতিভাত হয়, কারণ কাব্যের বাঁধাধরা নিয়ম এতে অনুপস্থিত। আর কুরআন গদ্যও নয়। এজন্য যে এর স্টাইল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত যা অন্য কোন গদ্যে পাওয়া যায় না। আয়াতের শেষাংশ বিশেষ নিয়মে সুবিন্যস্ত। সুরের সুললিত ঝংকারে আয়াতগুলো মাধুর্যমণ্ডিত। কাজেই কুরআন গদ্য বা পদ্য কোনটিই নয়। আমরা একে গদ্য-পদ্য বলতে পারি না। কুরআন একটি একক পদ্ধতি, অনুপম ও অতুলণীয়। পূর্বেও এমনটি ছিল না এবং পরেও এর তুল্য কিছু হয়নি। কুরআনের স্টাইলের কেউ অনুকরণ করতে পারেনি। কাজেই একথা সত্য যে, কুরআনের একটি বিশেষ স্টাইল রয়েছে, যার সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা চলে না। 

সেল বলেন ঃ এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, কুরআনের ভাষা, স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্যের দিক দিয়ে চূড়ান্ত সোপানে উন্নীত। মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআনের অলৌকিকত্ব দিয়ে নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করতে পেরেছেন। বড় বড় ব্যক্তি ও পণ্ডিতদের তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। হাজার হাজার মনুষ সে যুগে কুরআনের ভাষা ও শৈলীর বিপরীতে চমকপ্রদ কিছু সৃষ্টি করে বিজয়ী হতে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিল। কিন্তু কুরআন তাদেরকে মাত্র একটি আয়াত বা সূরা রচনা করতে চ্যালেঞ্জ করেছিল। জবাবে তারা নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ও নীরব ছিল। 

পাশ্চাত্যে মনীষী সেল আরো বলেন, “The Style of the Quran is generally beautiful and fluent and in many places specially where the many places specially where the majesty and attributes of God are described sublire and magnificent”.

আলী ইবন রব্বান আততাবারী বলেন ঃ আল কুরআনের ত্রটিবিহীন রচনাশৈলী ও সাহিত্যরীতি জগতের কোন ভাষায় বা গ্রন্থে মিলবে না।

আল কুরআনের রচনাশৈলী ও সাহিত্যরীতি সম্পর্কে ইবনে জারীর আততাবারীর অভিমত হচ্ছে ঃ কুরআনের চিরন্তর বাণী একটি অবিনশ্বর মুজিযাযা চিরদিন অক্ষুণœ থাকবে। মানুষের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার দ্বারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। কুরআনের রচনাশৈলী ও ভাষার লালিত্য এতই অসাধারণ যেযা অন্যসব আসমানী কিতাবের গুণাবলিকে øান করে দেয়্ তদানীন্তন আরবের কত সাহিত্যরথী ও বাগ্মীদেরকে হতবাক করে দিয়েছে। কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের সকল ধারনা ও প্রচেষ্টা একান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

অতএব বলা যায়আল কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলীর উৎকর্ষের কারণেই আল কুরআনের বিচ্ছুরণ ঘটেছে অপূর্ব সুর মূর্ছনায়। তাই কুরআন পাঠকালে পাঠকের হৃদয় পুলকিত হয়স্বর্গীয় আনন্দে তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে যায়। কুরআনের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ তা মূলত কুরআনের বিন্যাসপদ্ধতি ও শৈলীর কারণেই। এটা মহান আল­াহ তায়ালার অলৌকিক বিন্যাস কৌশল ও শিল্পনৈপুণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

সম্পর্কিত খবর

পরিশুদ্ধ নিয়ত

নিয়ত পরিশুদ্ধ রাখা কেন অনিবার্য ভাবে প্রয়োজন? ‘সাইয়িদুনা উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সমস্ত কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সন্তুষ্টির) জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত (বাস্তবিকই) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হয়েছে। আর যে ব্যক্তির হিজরতের (উদ্দেশ্য) ছিল, দুনিয়া উপার্জন বা কোনো নারীকে বিয়ে করা তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে।’ (সে আখিরাতে কোনো সাওয়াব পাবে না।) (সূরা মুমিনুন: ১১৫)

ইসলাম ও মাযহাব নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি ও তা নিরসন

লা মাযহাবির পক্ষ থেকে আর একটা প্রশ্ন করা হয়, ইমামগণ সাধারণ মানুষ; তারা তো নবী না। আর সবাই একমত যে নবী ছাড়া প্রতিটি মানুষ যত বড়ই ইমাম হোক সবাই সঠিক করতে পারে আবার ভুল করতে পারে। তাই আমি এমন একজন মানুষকে কিভাবে মানবো যে সঠিক করতে পারে আবার ভুল করতে পারে। ইমামকে মানা ওয়াজিব করে দেওয়া মানে একটা ভুল কাজ

সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব কুরআন মাজীদ

যাবতীয় কল্যাণ, সর্বপ্রকার জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা ও রহস্যের আধার হল আল কুরআন। একে অনুসরণ করেই দুনিয়া ও আখিরাতে পাওয়া যায় সুখের সন্ধান, মেলে সঠিক পথের দিশা। আল কুরআন মহান আল্লাহর বাণীর অপূর্ব সমাহার বিস্ময়কর এক গ্রন্থের নাম। আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সংরক্ষিত এক সংবিধান। আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হিদায়াত হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন। এই কুরআন যেমন সমগ্র মানব জাতির মানসিক সংশয়, সন্দেহ, অস্পষ্টতা, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা নামক নানা রকম রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের অব্যর্থ মহৌষধ ঠিক তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধি, বেদনা, কষ্ট-ক্লেশ এবং জীবন চলার পথের সকল অন্ধকার বিদূরিত করার এক অনবদ্য নির্দেশিকা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের প্রতিষেধক এবং মুমিনদের জন্য রহমত।’ (বনী ইসরাঈল : ৮২) এই কুরআন হল, সত্য-মিথ্যা এবং বৈধ-অবৈধের সীমা-রেখা

অহংকার ও আত্মতৃপ্তি

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তা‘আলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল­ামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও বর্ষিত হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর। মনে রাখতে হবে, অহংকার ও বড়াই মানবাত্মার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধি, যা একজন মানুষের নৈতিক চরিত্রকে শুধু কলুষিতই করে না বরং তা একজন মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির পথের দিকে নিয়ে যায়। যখন কোনো মানুষের অন্তরে অহংকার ও বড়াইর অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন তা তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও ইরাদার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তাকে নানাবিধ প্রলোভন ও প্ররোচনার মাধ্যমে খুব শক্ত হস্তে টেনে নিয়ে যায় ও বাধ্য করে সত্যকে অস্বীকার ও বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে। আর একজন অহংকারী সবসময় চেষ্টা করে হকের